ঐতিহ্য হারানোর পথে চারঘাটের খয়েরশিল্প

৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১২ পূর্বাহ্ণ উত্তরা প্রতিবেদক
ঐতিহ্য হারানোর পথে চারঘাটের খয়েরশিল্প
মাটির চুলায় বড় বড় হাঁড়িতে কাঠ জ্বালিয়ে খয়ের প্রস্তুত করা হচ্ছে।

একসময় চারঘাট মানেই ছিল খয়েরের রাজ্য। বাংলাদেশের একমাত্র খয়ের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে এ উপজেলার খ্যাতি ছিল দেশজুড়ে। পানের সঙ্গে খয়েরের মিষ্টি স্বাদ, প্রাকৃতিক রং, ঔষধি গুণ ও কেমিক্যাল ব্যবহার- সব জায়গায় চারঘাটের খয়েরের ছিল বিশেষ কদর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প এখন ধুঁকছে। হারাচ্ছে তার জৌলুশ।

চারঘাটে ১৯৪৭ সালে মুন্সী নুরুল হকের হাত ধরে খয়েরশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকে ভারত থেকে আগত বিহারীরা শিল্পটিকে নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ করেন। তখনকার দিনে চারঘাট থেকে খয়ের রপ্তানি হতো লাহোর, করাচিসহ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে। ষাট, সত্তর ও আশির দশক ছিল খয়েরশিল্পের সুবর্ণ সময়। স্থানীয়দের ভাষায়- ‘গ্রামের চার ভাগের এক ভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন খয়েরের ওপর নির্ভর করে।’

খয়ের উৎপাদনের মূল কাঁচামাল হলো খয়েরগাছ। প্রথমে গাছের ছাল তুলে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। এরপর মাটির পাতিলে বিশেষ চুলোতে জ্বাল দিয়ে রস বের করা হয়। এই রস আবার বড় ড্রামে জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়। একসময় তা জমে তৈরি হতো ‘লালি খয়ের’, যা কেবল চারঘাটের হাটে কেনাবেচা হতো। পরবর্তী ধাপে আগুনে জ্বাল দিয়ে ও মেশিনে চাপ দিয়ে তৈরি করা হতো চতুষ্কোণ গুটিখয়ের। শুকাতে সময় লাগত দুই থেকে তিন মাস।

খয়ের ব্যবসায়ীদের মতে, একসময় চারঘাটে ১০০-এর বেশি কারখানা ছিল। এখন টিকে আছে মাত্র ৮-১০টি। এর পেছনে রয়েছে নানা সংকট। প্রধান সমস্যা হলো খয়েরগাছের অভাব ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, প্রাচীন উৎপাদন পদ্ধতি, বিদেশি খয়েরের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, বিক্রি হওয়া পণ্যের মূল্য পেতে দীর্ঘসূত্রতা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্বাস আলী শেখ বলেন, ‘আগে সারা দেশে চারঘাটের খয়ের যেত। এখন খয়েরগাছই পাওয়া যায় না। বাবার ঐতিহ্য ধরে রেখেছি, কিন্তু ব্যবসা আর টিকছে না।’

আব্দুল হালিম নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, ‘একসময় লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে দ্বিগুণ লাভ হতো। এখন তিনগুণ বিনিয়োগ করেও লাভ মেলে না। অনেক ব্যবসায়ী দেনার ভারে জর্জরিত।’

খয়ের ব্যবসায়ী আশরাফ বলেন, ‘উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। কাঁচামালসংকট ও বিদেশি খয়েরের কমদামি বাজার দখল একে একে খয়ের কারখানাগুলোকে বন্ধ করতে বাধ্য করছে। অনেক কারখানার মালিক মূলধনসংকটে রয়েছেন। চাহিদা কমে যাওয়ায় কারও কারও নিজস্ব পুঁজি দিয়ে উৎপাদিত খয়ের বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে সরকারি সহযোগিতা না পেয়ে শিল্পের অবস্থা শোচনীয়।’

উৎপাদনকারী ও খয়ের সমিতির সদস্য এনামুল হক অভিযোগ করেন, ‘খয়েরশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এখনো কোনো সরকার উদ্যোগ নেয়নি। ঋণ, প্রশিক্ষণ বা বিপণন সহায়তা কিছুই নেই। তাই শিল্পটি পুনর্জীবিত করতে দরকার সরকারি সহযোগিতা এবং স্বল্পসুদের ব্যাংকঋণ।’

বর্তমানে চারঘাটে এক মণ লালি খয়ের বিক্রি হয় ১২-১৫ হাজার টাকা ও শুকনো গুটি খয়ের ৩০ হাজার টাকায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশি খয়ের, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার খয়ের, এখন বাজারে দাপট দেখাচ্ছে। তবুও গুণগত মানের দিক থেকে চারঘাটের খয়ের এখনো শ্রেষ্ঠ।

চারঘাট বাজার খয়ের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল রাজ্জাক বলেন, ‘সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এই শিল্প টিকবে না। কাঁচামালের সংকট নিরসনে খয়েরগাছ লাগানোর প্রকল্প প্রয়োজন।’

উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আব্দুল মুকিম বলেন, ‘খয়ের উৎপাদনকারী কারখানা সমিতি নামে সমবায় রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। তবে এখন তা কার্যকর নয়। আর্থিক সহায়তার কোনো সুযোগ নেই। তবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করা হবে।’

বন বিভাগের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর ১০ হাজার খয়েরগাছ লাগানো হচ্ছে। আগামী ১০ বছরে গাছের সংকট কমে যাবে।’
 

আরও পড়ুন.. উত্তরাঞ্চল
← প্রচ্ছদ